র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং এর সাবেক ও বর্তমান সাত শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার জন্য দেশটির আইন প্রণেতাদের চাপ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনকে এ তথ্য জানিয়েছেন। গত বুধবার সন্ধ্যায় টেলিফোনে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা হয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন গতকাল বৃহস্পতিবার (১৬ ডিসেম্বর) দুপুরে ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ ব্রিফিং করেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের সফরের বিভিন্ন দিক তুলে ধরতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই ব্রিফিং আয়োজন করেছিল। সেখানেই এক প্রশ্নের জবাবে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ তথ্য জানান।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় ভোরে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের সঙ্গে ফোনালাপে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিয়ে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের অংশীদারি অব্যাহত রাখার ইচ্ছা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা মানবাধিকারের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁরা দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদার ও অভিন্ন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হন।

ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গতকালের ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছে কি না? জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনালাপের মূল কারণটি ছিল নিষেধাজ্ঞা আরোপ। ব্লিংকেনের কাছে তিনি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি সরাসরি জানতে চাননি। ব্লিংকেনও বলেননি। তবে ব্লিংকেন বলেছেন, আলোচনার দরজা খোলা। নিষেধাজ্ঞা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, তিনি র‌্যাবের অর্জন ও সাফল্যগুলো যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেছেন। মন্ত্রী বলেন, ‘আমি বলেছি, আপনারা (যুক্তরাষ্ট্র) যে বাহিনীকে নিষিদ্ধ করেছেন সেটি সুশৃঙ্খল ও সফল। হলি আর্টিজানে হামলার পর সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণও এই বাহিনীর অন্যতম সাফল্য।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তাঁকে (ব্লিংকেন) বলেছি, র‌্যাবের ওপর এ দেশের জনগণের আস্থা আছে। অস্ত্র, মাদক চোরচালান, অপরাধ—এগুলো মোকাবেলা করা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক অগ্রাধিকার। র‌্যাব সফলভাবে এসব অপরাধ মোকাবেলা করছে। র‌্যাব মানবাধিকার লঙ্ঘন করে না, সুরক্ষায় কাজ করে।’

মোমেন জানান, ব্লিংকেনকে তিনি বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করতে পারত। সমস্যা হলে ব্লিংকেন সরাসরি তাঁকে ফোন করতে পারতেন। ব্লিংকেনও বলেছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনেরও যখন সমস্যা হবে তখন তিনি যেন সরাসরি তাঁকে ফোন করেন।

যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধ নিয়েও আলোচনা : পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনালাপে ওই দেশে প্রতিবছর ছয় হাজার লোক নিখোঁজ হওয়া এবং পুলিশের দ্বারা হাজারও ব্যক্তি হত্যার শিকার হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, “আমার দেশে কয়টা লোক নিহত হয়? আমার দেশে মারলে বলে বিচারবহির্ভূত হত্যা। আর আপনার দেশে পুলিশ মারলে বলে ‘দায়িত্ব পালনের সময় মৃত্যু’।”

এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ জলবায়ু, গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ অনেক ইস্যুতে একসঙ্গে কাজ করছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘তাঁর সরকার গণতন্ত্রের ওপর জোর দিয়েছে। আমিও বলেছি, আমরাও গণতান্ত্রিক দেশ। মানবাধিকারের ওপর জোর দিয়েছি। সারা দুনিয়ায় আমাদের উদ্যোগের প্রশংসা আছে।’

ফোনালাপের সময় কয়েকবার বদল : ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত বুধবার সকালেই তাঁরা ওয়াশিংটন ডিসি থেকে বার্তা পেয়েছিলেন অ্যান্টনি ব্লিংকেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, তাঁরা ফোনালাপের সময়সূচি ঠিক করতে পারছিলেন না। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে সময় দেওয়া হয়েছিল সে সময় তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করছিলেন। এরপর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে সময় দেওয়া হয়েছিল সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অন্য একটি দেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছিলেন। শেষ পর্যন্ত ব্লিংকেন যখন ফোন করেন তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বঙ্গভবনে ভারতের রাষ্ট্রপতির সম্মানে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ আয়োজিত রাষ্ট্রীয় ভোজসভায়। মোমেন জানান, ব্লিংকেনের সঙ্গে তাঁর অনেক সময় ধরে কথা হয়েছে।

নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে তলব ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানানোর কারণে যুক্তরাষ্ট্র বিচলিত বা অসহিষ্ণু হয়ে ফোন করেছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘নিশ্চয়ই না। আপনারা ওই ধরনের অলীক চিন্তা কিভাবে করেন?’

এ সময় পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, এ ধরনের আলাপ নিয়মিতই হয়। এর আগেও তো তাঁর (ব্লিংকেনের) সঙ্গে কথা, চিঠিপত্র চালাচালি হয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ব্লিংকেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর তিনিই প্রথম বিদেশি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। আগেও তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। দুজনের মধ্যে সদ্ভাব আছে।

এ পর্যায়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি যেটি বলেছেন, এবারের যে নিষেধাজ্ঞা হয়েছে সেটা অনেকটা হয়েছে কংগ্রেস, আইন প্রণেতাদের কারণে।’